flag

flag
Dooars Day, Ours Day.

১৪ই জানুয়ারী ‘ডুয়ার্স ডে’ অন্য আকাশ পানে ডুয়ার্স

১৪ই জানুয়ারী ‘ডুয়ার্স ডে’ অন্য আকাশ পানে ডুয়ার্স; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; জানুয়ারী ২০১৫; এখন ডুয়ার্স পত্রিকায় প্রকাশিত

উত্তরের জানালা দিয়ে আসছে হিমেল হাওয়া, ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু, উৎসবের পালা এখন শেষ। তবে অন্য এক ভিন্নধর্মী উৎসবে মাততে চলেছে ডুয়ার্স। পশ্চিম ডুয়ার্সের ওদলাবাড়ি থেকে কুমারগ্রাম। জলপাইগুড়ি জেলার তিস্তা থেকে সংকোশ নদী। ১৬০ কিমি লম্বা এই ভুখন্ড বর্তমানে ডুয়ার্স নামেই পরিচিত। মেচ, রাভা, টোটো, লিম্বু, রাজবংশী, কোচ, ওরাঁও, সাঁওতাল, মুন্ডা, বিহারী, বাঙালী, নেপালী, আরো বহু জাতি, জনজাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর বাস। সুবিশাল হিন্দু মন্দির, মসজিদ,  সুসজ্জিত গির্জা, নীল আকাশে হাত বাড়ানো বৌদ্ধ প্যাগাডোর চূড়া, গুরুদ্বার সবই আছে ডুয়ার্সে।  প্রায় ১৪৫টি ভাষা- উপভাষায় কথা বলে এই এলাকার মানুষ। সারা দেশে আয়তনের তুলনায় সবচেয়ে বেশী প্রকারের জনজাতির মানুষ বাস করে এই ডুয়ার্সে।

অতীতে সকলে পাশাপাশি থেকে একে অপরের সুখ-দুঃখের সামিল হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই অতীত ঐতিহ্যে আঘাত লাগে। ১৯৮৬ সাল থেকেই ডুয়ার্সকে গোর্খাল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে শুরু হয় এক নতুন আন্দোলন; যা ২০০৮ সালের দিকে তীব্র আকার নেয়। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, কামতাপুর পিপলস্ পার্টি, আরোকিছু ভাষা, জনগোষ্ঠী ও গনসংগঠনগুলির ডাকা বন্ধ, পরিবহন ধর্মঘট, পথ অবরোধে জেরবার হয় জনজীবন। অদুর অতীতে নরহত্যা, অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে শান্ত- শ্যামল এই জনপদে। ফলে কিছুটা হলেও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরী হয় বিভিন্ন ভাষা- সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। শিক্ষা- যোগাযোগ- স্বাস্থ্যপরিষেবা  বিভিন্ন বিষয়ে পিছিয়ে থাকা ডুয়ার্সে এ এক গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সেসময় নির্বিকার ভাব! তাদের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ বা সমস্যা নিরসনের কোন উদ্যোগ তেমনভাবে চোখে পড়েনি। এলাকার শান্তি ও উন্নয়নের চেয়ে ভোটের পাটিগণিতটা কারো কারো কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়।

এই পরিস্থিতিতে মূলতঃ সংবাদ মাধ্যমের সাথে যুক্ত থাকা মানুষেরা এগিয়ে আসেন। সঙ্গে যোগ দেয় কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ক্লাব ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। ২০১০সালের ১৮ই নভেম্বর ধূপগুড়ি ব্লকের বানারহাটে একসভায় আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, পিপিপি, ডুয়ার্স মিল্লাত ইসলামিয়া, কামতাপুর পিপলস্ পার্টি- এইসব নীতি-আদর্শগতভাবে পরস্পর বিরোধী সংগঠনগুলিকে মুখোমুখি আলোচনার টেবিলে বসিয়ে বিভিন্ন মহলে সাড়া ফেলে দেয়। সরকার-প্রশাসন যে কাজ করতে এতদিন ব্যর্থ হয়েছে, ঢাল তলোয়ারহীন সামান্য কয়েকজন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এই অসাধ্য কীভাবে সাধন করলো ? সে প্রশ্নই ঘুরেছে সাধারণমানুষের মুখেমুখে । সেসভায় সোজা সাপটাভাবে বলা হয়- "বিভিন্ন ভাষাভাষী- সম্প্রদায় ও গণসংগঠনের গণতান্ত্রিক দাবীদাওয়া  থাকতেই পারে, তবে খেয়াল রাখতে হবে তাদের আন্দোলনের পদ্ধতি যেন সাধারণমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হনন না করে। কামতাপুর পৃথক রাজ্য, ষষ্ঠ তপশীল, গোর্খাল্যান্ড এইসব বিভিন্ন দাবী  পুরণ করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের রয়েছে। যা দিল্লী বা কলকাতায় বসে থাকা কর্তাব্যাক্তিদের বিষয়। গঙ্গা বা যমুনা-র ওপারে থাকা নীতি প্রণেতারা কী সিন্ধান্ত নেবেন সেটা পরের বিষয়। সেক্ষেত্রে ডুয়ার্সে থাকা মানুষজন নিজেদের মধ্যে কেন পারস্পরিক হানাহানিতে লিপ্ত হবে ? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা মাথায় রেখেই বিষয়টিকে ভাবতে হবে।" আশি ছুঁই ছুঁই চা শ্রমিক সংগঠক চিত্ত দে -সে সভায় সভাপতিত্ব করেন। সেই সভায় ঠিক হয় আগামী অর্থাৎ ২০১১ সালের ১৪ই জানুয়ারী ডুয়ার্সের শান্তি-সম্প্রীতি ও প্রগতির লক্ষ্য নিয়ে পালিত হবে ‘ডুয়ার্স ডে’।

১৮৬৪ সালের ১৪ই জানুয়ারী ব্রিটিশ সার্জেন রেইনী তৎকালীন বড়লাট লর্ড এলগিনকে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন- ডুয়ার্স এলাকার ভৌগোলিক গুরুত্ব, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা। তারপর থেকেই ব্রিটিশ সরকার এই এলাকায় তাদের প্রভাব বিস্তারের দিকে অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র এই পান্ডববর্জিত জনমানবহীণ এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার উদ্দেশ্য ছিল পার্শ্ববর্তী ভুটান, নেপাল, তিব্বত ও চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর ইংরেজদের সামরিক নজরদারী বাড়ানো। অরণ্য- বনানী কেটে তৈরী হয় চা-বাগিচা, শুরু হয় রেললাইন পত্তনের কাজ। সেকারণেই বেছে নেওয়া হয় এই দিনটিকে।

ডুয়ার্স  বা চা-বাগান ঘিরে এর আগে যে কোন উৎসব হয় নি তা নয়।  বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদা একাট্টা করে এক জায়গায় বড় প্যান্ডেল হয়েছে। এসেছে সরকারী ও বেসরকারী আর্থিক আনুকুল্য, মন্ত্রী মশাই ফিতে কেটেছেন। বুকে রাধাবল্লভীর মতো বড়সড় ব্যাচ, মন্ত্রীমহোদয়ের দীর্ঘ রাজনৈতিকভাষণ, পেছনে বসে থাকা দর্শকদের হাই তোলা। উদ্যোক্তাদের নাম ছাপানো ব্যাগ, টুপি, স্পন্সর কোম্পানির বড়সড় স্টল। সাথে ফুচকা, এগরোল, চাওমিন...। অনুষ্ঠানের পর উদ্যোক্তাদের বিরূদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও স্বজনপোষনের অভিযোগও ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায় পাতায়। এসব কিছুই করতে রাজি হয়নি এই অভিনব উৎসবের আয়োজকেরা। হোক না সবকিছু প্রাণের পরশে? নবীন আবেগে! সেটাই তারা চাইছেন। যেভাবে জিতিয়া-করম, ফুলপাতি, ইদ্, হোলি হয় সেভাবেই কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হোক এক উৎসব। কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নয় ডুয়ার্সে বসবাসকারী সকল মানুষের আন্তরিক উৎসব।

তৈরী হয় দিবস উদযাপনের প্রতীক বা লোগো। ডুয়ার্স কথাটির উৎপত্তি ইংরাজি ‘ডোর’ বা বাংলার ‘দ্বার’ শব্দ থেকে। দরজা খুলে একজন তাকিয়ে আছে উত্তরের দিকে, দূরে পাহাড়ের দুই শৃঙ্গের মাঝ থেকে সূর্য উঠছে। সম্মুখে আলোকিত সূর্য, পেছন পানে অন্ধকার। নতুন প্রভাতের পানে দন্ডায়মান এক ছায়ামূর্তি- অদ্ভুত ব্যাঞ্জনা ভরা এই ডুয়ার্সদিবসের প্রতীক।

বিবাহ বা চাকরী সুত্রে যারা এখন ডুয়ার্সের বাইরে রয়েছে ১৪ই জানুয়ারী এদিনের জন্য সকলকে নিজ নিজ বাড়িতে ফেরার ডাক দিয়েছে উদ্যোক্তা সমিতি। এভাবেই পঁচিশবছর পর দেখা হচ্ছে কালচিনির সুনিতা ছেত্রীর সাথে গার্গী গাঙ্গুলীর। বহুবছর পর মিলিত হবে বাল্য বন্ধু . . . ।

এদিন সন্ধ্যায় আলোকমালায় সাজবে ডুয়ার্স । ডুয়ার্সের প্রতিটি হিন্দুমন্দির,  মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার, বৌদ্ধমন্দির, অফিস-কাছারি, বাড়িঘরে সন্ধ্যা ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত প্রদীপ- মোমবাতি- বিজলিবাতি জ্বালাবে এই এলাকার মানুষজন। না একে কেউ দীপাবলী বলছেন না; বলছেন আলোক উৎসব। কেন না সেই নামের সাথে এক বিশেষ ধর্মের ছোঁয়া রয়েছে।  

হ্যাঁ 'ডুয়ার্স ডে' ব্যক্তি বিশেষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে ধরা দিয়েছে। ডুয়ার্স আঞ্জুমান সমিতির সভাপতি রেজা করিম- "পবিত্র ঈদ্ যেমন দীর্ঘ অনুশীলনের পর খুশির তোফা নিয়ে আসে, ঠিক সেভাবেই ডুয়ার্স দিবস আমাদের কাছে আসে।"

"হ্যাপি ক্রিসমাসের হিমেল মিষ্টি আমেজ নিয়ে আমরা সবাই মিলে আবার মাতবো আনন্দে। সান্তাক্লজ আমাদের ডুয়ার্সবাসীর জন্য ১৪ই জানুয়ারী অনেক শান্তি- সম্প্রীতি ও উন্নয়নের বার্তা নিয়ে আসবে" -এই কথাই জানালেন বিন্নাগুড়ি চা বাগিচার প্রিষ্ট সাইমান।

ডুয়ার্স হলো লোকসংস্কৃতির অন্যতম খনি। মেচ, রাভা, কোচ, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, আরো কতসব জনজাতির সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ এই ভুখন্ড। বর্তমানে বলিউড কালচারের প্রভাবে হারাতে বসেছে সেই পুরোনো ঐতিহ্য। অনেকের আশা 'ডুয়ার্স ডে'-তে লোক সংস্কৃতির পুনর্জীবন ঘটাবে। প্রাণের আবেগে গাইবো সবাই মিলিত ঐকতানে। লোকসংস্কৃতি চর্চার ওপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে এই উৎসবের আয়োজকেরা। তারা মনে করছেন সুর-তাল-ছন্দের কোন জাতপাত ধর্ম-বর্ণ নেই, এটা সর্বত্রগামী।




No comments

" সাগাই হামার বাড়িত আসিয়া যান, শুটকা- সিদল খায়য়া যান"।

  " সাগাই হামার বাড়িত আসিয়া যান, শুটকা- সিদল খায়য়া যান"।                    -বলাই চন্দ্র দাস। সিদল উত্তর বঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ে...

Powered by Blogger.