ঔপনিবেশিক ডুয়ার্সে ‘পূর্ববঙ্গের বাঙালি সমাজ'
‘ঔপনিবেশিক ডুয়ার্সে পূর্ববঙ্গের বাঙালি সমাজ' এই বিষয়ের শিরোনাম সম্পর্কে ইতিহাসমনস্ক মানুষকে কিছু বলা প্রয়োজন। কারণ ‘পূর্ববঙ্গের বাঙালি সমাজ' শব্দবন্ধ এখন ব্যবহার হয় না। তাই বিশেষ কমা চিহ্ন ব্যবহার করেছি। অর্থাৎ ডুয়ার্স যখন ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে ছিল তখনই পূর্ববঙ্গের বাঙালি যুবকদের একটি অংশ ডুয়ার্সে এসেছিল কর্মের সন্ধানে বা তাদেরকে প্রলোভিত করা হয়েছিল এখানে আসার জন্য। “প্রলোভিত” শব্দ সচেতন ভাবেই ব্যবহার করলাম। কারণ “পাণ্ডববর্জিত” বলে কথিত, দুরারোগ্য রোগের ডিপো, প্রতিকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে ডুয়ার্সে পূর্ববঙ্গের ভদ্রলোকদের পরিবারের সন্তানেরা কেন এসেছিলেন? হিংস্র পশুর বাসস্থান, দূর্ভেদ্য জঙ্গল, ভুটিয়াদের লুটপাটের ‘স্বর্গরাজ্যে’ তাঁরা কি স্বেচ্ছায় এসেছিলেন? জলপাইগুড়ির ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার প্রণেতা গ্রুনিং সাহেব ১৯১১ সালে যা লিখেছেন তার বঙ্গানুবাদ তুলে দিচ্ছি- ‘ডুয়ার্সের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে সেখানকার অধিবাসীরা মাঝে মাঝেই দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। এই প্রসঙ্গে ডক্টর বেন্টলে যা লিখেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ২০০ জনের মতো ইউরোপীয়ান বসবাস করে ডুয়ার্সে এবং সেখানকার মারাত্মক ব্যাধি হচ্ছে ম্যালেরিয়া। নতুন যারা ডুয়ার্সে আসে, তারা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ম্যালেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই অঞ্চলে নতুন যারা আসে তাদের প্রত্যেকেরই কয়েকদিনের মধ্যে ম্যালেরিয়া হয়। হতে বাধ্য.....। কোনোভাবেই ম্যালেরিয়াকে প্রতিরোধ করা যায় না। ইউরোপীয়ান যারা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের অনেকেই হয় পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন, না হয় তাদের মৃত্যু হয়েছে।... ইউরোপের অধিবাসীরা ডুয়ার্সে প্রথমে এসে বেশ খুশি থাকে। কারণ ডুয়ার্সের অরণ্য।..... কিন্তু সেখানকার প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়া যে কি ভয়ঙ্কর তার কোনো ধারণাই তাদের নেই। (সূত্র: স্টেটসম্যান শতবর্ষ আগে, ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯১১’।
এইরকম প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশে পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্ণের পরিবারের মধ্যে শিক্ষিত এবং উচ্চ শিক্ষিতরা এসেছিলেন ডুয়ার্সে ১৮৬৪-৬৫ সালে দ্বিতীয় ইংরেজ ভুটান যুদ্ধের পরে। কিন্তু কেন তারা এসেছিলেন? অবশ্যই কর্মসংস্থানের তাগিদে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল না। ইতিহাস ও অর্থনীতি মনস্ক পাঠক নিশ্চয়ই জানেন যে পূর্ববঙ্গ ছিল কৃষিপ্রধান অঞ্চল। সেখানে ঔপনিবেশিক সরকার ভারী শিল্প স্থাপন করেন নি বা করতে পারেন নি। কৃষিপ্রধান পূর্ববঙ্গের কাঁচা পাট দিয়ে চলত হুগলি হাওড়ার জুট ইন্ডাস্ট্রি। কারণ দক্ষিণবঙ্গে পাট তেমন হতো না। পূর্ববঙ্গের পাট দিয়েই কলকাতা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের জুটমিলগুলো চলত। ইস্পাত, ফার্মাসিউটিক্যালস বা অন্য কোনো ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি। পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত যুবকদের চাকরীর ক্ষেত্র ছিল স্কুল শিক্ষকতা এবং কলেজের অধ্যাপনা। এটি উনিশ শতকের কথা। কিন্তু বিশ শতকের প্রথম থেকেই শিক্ষিত যুবকদের একাংশ ইংরেজবিরোধী তথা বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। ফলে ইংরেজ সরকারের চাকরি পেতেও তাদের নানারকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এটি প্রথম পর্বের কথা নয়, দ্বিতীয় পর্বের। প্রথম পর্বে মৃত্যুকে বাজি রেখে পূর্ববঙ্গের মধ্য শিক্ষিত যুবকেরা চা-বাগানে এবং উচ্চশিক্ষিত যুবকেরা শিক্ষালয়ের চাকরি নিয়ে বা চিকিৎসা পরিসেবার দায়িত্ব নিয়ে ডুয়ার্সে এসেছিলেন। অজস্র উদাহরণ দিয়ে পাঠকবর্গকে ভারাক্রান্ত করতে অনাগ্রহী। তবু কিছু নামের উল্লেখ করতে হয় তথ্য, সত্য ও ইতিহাসের খাতিরে। আলিপুরদুয়ারের মুখার্জি পরিবারের উজ্জ্বল ও কৃতী ছাত্র শ্রী নীলকান্ত মুখার্জী ডিস্টিংশন নিয়ে বিএসসি পাশ করে ডুয়ার্সে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেছিলেন। অথচ এরকম উজ্জ্বল ছাত্র নীলকান্তবাবু বঙ্গদেশ এবং বঙ্গদেশ বহির্ভূত যে কোন নগরে চাকরি পেতে পারতেন। যেমন অনেকেই অন্য প্রদেশে চাকরি করতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু নীলকান্ত বাবুর মত অনেকেই সেই সময় এই “ম্যালেরিয়া মৃত্যু দেশে” কর্মসূত্রে এসেছিলেন এবং থেকে গিয়েছিলেন।
এই জঙ্গল, জলাভূমি, হিংস্র প্রাণী এবং দুরারোগ্য ভূখণ্ড তথা ‘আফ্রিকার টাঙ্গানিকা'তে আগে তাঁরা পূর্ববঙ্গের গ্রামের মতন শিক্ষায়তন, নাট্য প্রতিষ্ঠান, খেলাধুলার চর্চা, পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। একইভাবে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এসেছিলেন মানুষের সেবা করতে। অবশ্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছু পূর্ববঙ্গীয় অভিবাসী বাঙালি চিড়া-গুড় থলিতে নিয়ে চারবার যানবাহন পরিবর্তন করে চা বাগানে পৌঁছেছিলেন আর ইউরোপীয়দের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা করে চা বাগান গড়ে তুলেছিলেন। এর ফলে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য শ্রমিকের কর্মসংস্থান। পাশাপাশি আরও বহু রকমের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছিল। চা বাগানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরও একটি নতুন দিগন্তের উদয় হয়েছিল। তা হল কাঠের ব্যবসা। আগে কাঠের ব্যবসার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কাঠ যে অর্থনৈতিক উন্নতির একটি ধারা হতে পারে, তা এখানে অজানা ছিল। আর এই কাঠের ব্যবসার সূচনাতেও ডুয়ার্স অঞ্চলে বাঙালি ভাগ্যান্বেষীরা তথা অভিবাসীরা তাদের জায়গা করে নিয়েছিল। কাঠের ব্যবসার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। সেটা হল কাঠের ব্যবসাই একমাত্র ব্যবসা যা বাঙালির একচেটিয়া ছিল এবং আছে। অন্য সব ব্যবসা থেকে বাঙালিরা হটে গেলেও কাঠের ব্যবসাতে এখনো টিকে আছে।
তাই বলা যায় ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে
যে “আফ্রিকার টাঙ্গানিকা” ডুয়ার্সকে
আজ শিক্ষা-সংস্কৃতি, বাণিজ্য, পর্যটনে সমস্ত
ক্ষেত্রে সুপরিচিত করতে “পূর্ববঙ্গীয়
বাঙালি” সমাজের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। আর এই পূর্ববঙ্গীয় বাঙ্গালীদের কিছু পরেই এসেছিলেন
ছোটনাগপুরের আদিবাসী সমাজের একাংশ। এরা এসেছিলেন বা
আসতে বাধ্য হয়েছিলেন আরকাঠিদের প্রলোভনে। আজকের ডুয়ার্সের অর্থনীতির পরিবর্তনে এদের ঘাম এবং শ্রম অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। এরাও সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় অভিবাসী আদিবাসী। এরা অভিবাসী হলেও ডুয়ার্সকে ভালবেসে সেখানেই স্থিত
হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এই শ্রমিকশ্রেণী
থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে মধ্যবিত্ত সমাজ। আমাদের মনে রাখতে হবে আজকের মধ্যবিত্ত সমাজ আর স্বাধীনতার পূর্বের মধ্যবিত্ত
সমাজের আদর্শ ও মানসিকতা এক নয়। মধ্যবিত্ত সমাজের
ইতিবাচক ভূমিকার কথা আমরা জানি। কিন্তু তার নেতিবাচক দিকটিও আমরা এখন পর্যবেক্ষণ করছি। মনে হচ্ছে যে ডুয়ার্স এখন ইতিহাসের চৌমাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। কোন দিকে মোড় নেবে তা ইতিহাসই হয়তো আগামী দিনে বলতে
পারবে। ডুয়ার্স ডে পালনকারীদের আদর্শ
এবং লক্ষ্য নিঃসন্দেহে মহৎ। কিন্তু সেইসঙ্গে
পথ মসৃণ নয়। কবিগুরুর ভাষায় বলা যেতে পারে
পথে পথে কন্টকের অভ্যর্থনা।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শ্রী ব্রজগোপাল ঘোষ, শ্রী রাম
অবতার শর্মা, ডক্টর সমীরেন্দ্র প্রসাদ চক্রবর্তী, শ্রী গৌতম চক্রবর্তী)
ছবি সৌজন্য- গৌতমেন্দু রায়।
No comments